বিমান বিধ্বস্ত, শোকে স্তব্ধ দেশ

বিমান বিধ্বস্ত, শোকে স্তব্ধ দেশ

মর্মান্তিক। হৃদয়বিদারক। পুরো দেশ শোকে স্তব্ধ। নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৪৯ যাত্রী নিহত হয়েছেন। সোমবার স্থানীয় সময় আড়াইটার দিকে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ দুর্ঘটনার শিকার হয় বিএস২১১ ফ্লাইটটি। বিমানটিতে চার ক্রুসহ ৭১ আরোহী ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ বাংলাদেশি, ৩৩ নেপালি এবং চীন ও মালদ্বীপের একজন করে নাগরিক ছিলেন। যাত্রীদের ৩৭ পুরুষ, ২৮ নারী এবং দুজন শিশু ছিল। আহতদের মধ্যে এয়ারক্রাফটের ক্যাপ্টেন আবিদসহ ১৬ জনকে নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিমানটি ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডু যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর পর কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। ৪ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের কার্যক্রম ফের চালু হয়। এ ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিবিসির খবরে বলা হয়, অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন ঘটনাস্থলেই এবং ৯ জন হাসপাতালে নেওয়ার পর। অপর ৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে তাদের কেউই জীবিত নেই। আহত ১৮ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এদিকে আলজাজিরা জানিয়েছে, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে পাইলটের ত্রুটিকেই প্রধান হিসেবে দেখছে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ। তবে এ দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের সন্ত্রাসের যোগসূত্র আছে বলে মনে করেন না স্থানীয় গণমাধ্যম জনতাপোস্টের ফটোজার্নালিস্ট সরজ বাসনেত। তিনি আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, ‘বৈরী আবহাওয়াই একমাত্র কারণ’।
ঢাকা থেকে ফ্লাইটটি নেপালের উদ্দেশে ছেড়ে গিয়েছিল। রানওয়ের কাছে একটি ফুটবল মাঠে সেটি বিধ্বস্ত হয়। আগুন ধরে যায় পুরো বিমানে। বিধ্বস্ত হওয়ার পর উদ্ধারকাজে যোগ দেয় নেপালের সেনাবাহিনী।
দুর্ঘটনার আধা ঘণ্টার মধ্যেই নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাম বাহাদুর থাপা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। তিনি উদ্ধারকাজে তৎপরতার ওপর জোর দেন। এদিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী খাজা প্রসাদ শর্মা ওলি টেলিফোনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানান। তিনি সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি দ্রুত তদন্তের নির্দেশও দেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় বিমান বিধ্বস্তের শিকার সব মানুষের জন্য প্রার্থনা করেন।
ঠিক কী কারণে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হলো, তাৎক্ষণিকভাবে তা স্পষ্ট নয়। যদিও ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়েছে, তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আলজাজিরা জানিয়েছে, ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার জন্য পাইলটকেই দুষছে। টিআইএর জেনারেল ম্যানেজার রাজকুমার ছেত্রি বলেছেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, পাইলট তা না মেনে ভুল দিক থেকে বিমান অবতরণ করছিলেন। প্রথম দিকে অবশ্য বৈরী আবহাওয়াকেই দায়ী করা হচ্ছিল।
বিবিসি জানিয়েছে, বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ১৭ বছরের পুরনো।
ঘটনার পর ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের ভুল বার্তাকে দায়ী করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় পাইলটের গাফিলতি ছিল না বলে তারা দাবি করেন। অন্যদিকে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) রাজলংমার ছেত্রি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, বিমানবন্দরে অবতরণকালে কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশনা মানেননি পাইলট। নির্দেশনা না মানার পরক্ষণেই এটি বিধ্বস্ত হয়। এ নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর পরই ঢাকা থেকে ক্যাপ্টেন লুৎফরসহ কাঠমান্ডুতে গেছে একটি প্রতিনিধি দল।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশের কোনো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৪ সালে। ওই বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার এফ-২৭ বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জন নিহত হন।
গতকালের বিমান ধসের ঘটনায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নেপালের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অর্ধশতাধিক নিহত হওয়ার শঙ্কা জানিয়েছে। নেপালের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র গোকুল ভা-ারি এএফপিকে বলেন, কাউকে জীবিত উদ্ধার করার আশা প্রায় শেষ। কারণ বিমানটি ভয়াবহভাবে পুড়ে গেছে।
কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই বিমানের যাত্রীদের মধ্যে ১৭ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগের জন্য একটি হটলাইন খুলেছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ডিজি সঞ্জিব গৌতমের বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, ড্যাস-৮ কিউ৪০০ মডেলের বিমানটি ত্রিভুবনে নামার কথা ছিল রানওয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। কিন্তু সেটি নামার চেষ্টা করে উত্তর দিক দিয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, পাইলট কোনো ধরনের কারিগরি জটিলতায় পড়েন। তবে ইউএস বাংলার প্রধান নির্বাহী আসিফ ইকবাল বলেন, নেপালের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ভুলবার্তায় এমনটি ঘটেছে বলে সন্দেহ করছি। উড়োজাহাজটি কোন দিকে নামবে সে বিষয়ে ক্যাপ্টেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। ক্যাপ্টেন আবির খুবই দক্ষ। ফ্লাইংয়ে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার কোনো গাফিলতি ছিল না।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী শাহজাহান কামাল গতকাল সিভিল এভিয়েশন কার্যালয়ে জানিয়েছেন, বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটিতে ৪৩ বাংলাদেশি যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা ১৪ যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সহকারী পাইলট আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।
বিমানমন্ত্রী জানান, উড়োজাহাজের ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরে আরও তথ্য জানাবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল এভিয়েশন)। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে তিনি আগামীকাল (মঙ্গলবার) নেপালে যেতে পারেন। বিষয়টি নির্ভর করছে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলে দেওয়ার ওপর।
এদিকে নেপালে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার ফ্লাইটটির বাংলাদেশি যাত্রীদের স্বজনরা উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছেন। ভিড় করছেন বারিধারায় ইউএস-বাংলা অফিসে। ওই ঘটনায় একাধিকবার ব্রিফ করে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের তথ্য সহায়তায় চালু করেছে হটলাইন। এ নিয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ব্রিফিংয়ে বলেন, ওই ঘটনায় কারা দায়ী তা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ নিজ ব্যবস্থাপনায় আহতদের চিকিৎসা ও সবার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করবে। আর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বীমা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ হিসেবে আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান ত্রাণমন্ত্রী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, নেপালে বাংলাদেশের হাইকমিশন সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে হটলাইন খোলা হয়েছে। জরুরি চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার, নার্সসহ একটি উড়োজাহাজ পাঠানোর কথা রয়েছে।
এদিকে উড়োজাহাজে থাকা নেপালি এক যাত্রীর বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, যাত্রীদের মধ্যে ১৬ জন নেপালি। বহোরা নামে ওই যাত্রী জানান, ঢাকা থেকে উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের সময় স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কাঠমান্ডুতে অবতরণের সময় এটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে।
এ ফ্লাইটেই যাত্রী ছিলেন বাংলাদেশের সানজিদা বিপাশা, রফিক জামান রিমু ও তাদের ছয় বছর বয়সী ছেলে অনিরুদ্ধ। বিপাশার ভাই শাহরিয়ার মিঠুন বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টায় তাদের তুলে দেওয়ার সময় সবশেষ কথা হয়েছিল। এর পর দুর্ঘটনার খবর শুনছি। রুয়েটের সিএসই বিভাগের প্রভাষক ইমরানা কবির হাসিও ছিলেন এ ফ্লাইটে। স্বামী রকিবুল হাসানও ছিলেন তার সঙ্গে। হাসির বাড়ি টাঙ্গাইলে। তিনি যাত্রা শুরুর আগে ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘ভ্যাকেশন স্টার্টস নাউ’। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকে হাসি ও রকিবুলের স্বজনরা রয়েছেন উদ্বেগের মধ্যে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধান নাজিয়া আফরিন চৌধুরী এবং বেগম উম্মে সালমাও ছিলেন এই ফ্লাইটে। তারা একটি কর্মশালায় অংশ নিতে কাঠমান্ডু যাচ্ছিলেন। একই ফ্লাইটে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালকের দুজন আত্মীয় ছিলেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী ও কলেজ ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পিয়াস রায়ও এ ফ্লাইটে ছিলেন। যাত্রা শুরুর একটি ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘টাটা মাই কান্ট্রি, ফর ফাইভ ডেজ। হেইলিং টু দ্য ল্যান্ড অব দ্য এভারেস্ট’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ত্রিভুবন বিমানবন্দর খোলার সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যকারী দল নেপালে পাঠাবেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় যত রকমের সাহায্য দরকার বাংলাদেশ তা করবে। একই ঘটনায় স্পিকার, বিরোধী দলের নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment